You are here : Home Obituary

অধ্যাপক দ্বিজেশকুমার দত্ত মজুমদার
(১০.০২.১৯৩২ - ২৭.০৬.২০২০)
বিশিষ্ট কম্পিউটার বিজ্ঞানী অধ্যাপক দ্বিজেশকুমার দত্ত মজুমদারের জীবনাবসান হয়েছে গত ২৭.০৬.২০২০ তারিখে। ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান অকাদেমির (Indian National Science Academy) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক দত্ত মজুমদার কলকাতার ভারতীয় সাংখ্যিকীয় সংস্থানের (Indian Statistical Institute, Kolkata) কম্পিউটার এবং কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসাবে অবসর গ্রহণের পরে তিনি ওই সংস্থার ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। এরই পাশাপাশি তিনি কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)-এর ইমেরিটাস বিজ্ঞানী হিসাবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও অসংখ্য সারস্বত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। দেশের একজন প্রথম সারির কম্পিউটার বিজ্ঞানী হিসাবেই নয়, এ রাজ্যের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি নিবিড়ভাবে ওতপ্রোত ছিলেন। কর্মজীবনে অসংখ্যা কৃতি ছাত্রছাত্রী যেমন তৈরি করেছেন—তাঁদের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে তাঁদের পথ দেখিয়েছেন, তেমনই যেকোনও জিজ্ঞাসুর আশ্রয় হয়ে থেকেছেন সারা জীবন। চারপাশের মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর ছুটে যাওয়া তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছের ব্যক্তিত্ব করে তুলেছিল।
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক (সাম্মানিক) হন প্রথম শ্রেণি পেয়ে। এর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (সায়েন্স কলেজ, রাজাবাজার) থেকে রেডিও ফিজ়িক্স এবং ইলেকট্রনিক্স-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ ১৯৫৫ সালে। পিএইচ.ডি. ওই একই বিষয়ে ১৯৬২ সালে। এর পরেই কর্মজীবন শুরু করেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের কম্পিউটার ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগে। এখানেই তিনি প্রথম ম্যাগনেটিক মেমোরি সিস্টেম এবং অন্যান্য ডিজিটাল ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরি করে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন। ভারতে প্রথম সলিড স্টেট ট্রানজ়িস্টরাইজ়ড কম্পিউটার (যা আইএসআই-জেইউ-১ নামে পরিচিত) এবং উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন রিড/রাইট সার্কিট তৈরির কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৪ সালে অধ্যাপক দত্ত মজুমদার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে এন. আর. স্কটের সঙ্গে ইউনাইটেড নেশান্স ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় ডিজিটাল কম্পিউটার সিস্টেম ডিজ়াইন, প্যাটার্ন রেকগনিশন এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্যা নিয়ে কৃত্রিম এবং মানবীয় বুদ্ধিমত্তার এলাকায় কাজ করেন। ভারতীয় সাংখ্যিকীয় সংস্থানের কম্পিউটার কমিউনিকেশন সায়েন্স বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ওই সংস্থার ফিজ়িক্যাল এবং আর্থ সায়েন্স বিভাগের নেতৃত্বও দিয়েছেন। আইএসআই-এর প্রশাসন পরিচালনাতেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল—ওই সংস্থার যুগ্ম সচিব এবং সহযোগী পরিচালকের আসনও অলংকৃত করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
অধ্যাপক দত্ত মজুমদারের বিশেষজ্ঞতার ক্ষেত্র ছিল বহুধা বিস্তৃত। প্যাটার্ন রেকগনিশন, ফাজ়ি ম্যাথামেটিক্স, সাইবারনেটিক্স, পরীক্ষামূলক ধ্বনিবিজ্ঞান চর্চায় তাঁর প্রবেশ অতি গভীর এবং অবদান অনপনেয়। ফাজ়ি ম্যাথামেটিক্স-এ তিনি অনুসন্ধানের নতুন পদ্ধতি এবং তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ২৫ জন গবেষক পিএইচডি গবেষণা করেছেন, স্নাতকোত্তর স্তরে শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে পথ দেখিয়েছেন। আইএসআই-এর কম্পিউটার এবং কমিউনিকেশন্স সায়েন্স বিভাগে বৃহত্তম গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।
আইএসআই-এর বাইরেও তাঁর কর্মের এলাকা বিস্তৃত ছিল। কম্পিউটার সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া, প্যাটার্ন রেকগনিশন এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর ভারতীয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক দ্বিজেশ দ্ত্ত মজুমদার ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ফাজ়ি ম্যাথামেটিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রসেসিং-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সাম্মানিক পরিচালক-সচিব ছিলেন তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্র ইন্সটিটিউট অভ সাইবারনেটিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনলজির।
কাজের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছিলেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। নর্বার্ট উইনার অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৭), পি. সি মহলানবিশ মেডেল (১৯৯৩), ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান অকাদেমির জহরলাল নেহরু জন্ম শতবর্ষ বক্তৃতা পুরস্কার (১৯৯৪), শ্রী ওমপ্রকাশ ভাসিন পুরস্কার (১৯৯৬), ফ্র্যাঙ্ক জর্জ গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৯), বিশ্বভারতীর রথীন্দ্র পুরস্কার (২০০১), বেঙ্গল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ পুরস্কার (২০০৩), ওকলাহোমা স্টেট কলেজের নর্বার্ট বিজয়ী পুরস্কার (২০০৫), ইত্যাদি। পাঁচশোর বেশি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায়। একক ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যাও বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে সক্রিয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য প্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগের অধীনে গড়ে ওঠা ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ, কলকাতা-র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের কাজের রূপরেখা তৈরি, তার নেতৃত্ব দেওয়া, সঠিক পথে এগিয়ে দেওয়ার তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান কান্ডারি। পরিষদের সূচনালগ্ন থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এর সঙ্গে। তাঁর চলে যাওয়া পরিষদের সমস্ত কর্মীর কাছে নিকটতম অভিভাবকের প্রয়াণের মতো বেদনাবহ। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায় ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের সমস্ত কর্মী।